Friday, February 28, 2014



কার্যকরন নীতিতে মানুষ হত্যা : দায়ভার কার উপর বর্তাবে


বরিশাল বিভাগের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারী বি এম কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস নিচ্ছিলেন । হঠাৎ করেই একই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের একজন ছাত্রী এসে স্যারের অনুমতি না নিয়ে ক্লাসে ঢুকে , স্যারকে জিজ্ঞাসা করে-স্যার আমাদের ক্লাস শুরু হবে কবে ? স্যার প্রশ্ন শোনার আগেই খুব রেগে যান এবং ঐ ছাত্রীকে বকা-ঝকা করে ক্লাস থেকে বের করে দেন । ছাত্রীটি ক্লাস থেকে বের হওয়ার পরে স্যার একটি ছাত্রকে জিজ্ঞাস করলেন বলোতো আমি ওকে বকা দিলাম কেন ? ছাত্রটি সবিনয়ে বলল স্যার সে আপনার অনুমতি নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করেনি তাই । স্যার ছাত্রটির উত্তরকে সঠিক হিসেবে সত্যায়ণ করে বললেন , এটা কার্যকরন নীতির সূত্র । অর্থ্যাৎ কোন কাজের জন্য তার পিছনে কারন থাকা আবশ্যক । আমার বকার পিছনে কারন ছিল সে অনুমতি ছাড়া ক্লাসে প্রবেশ করার অপরাধ । কাকতালীয় ভাবে স্যারের ঐদিনের আলোচ্য বিষয় ছিল কার্যকরন সম্মন্ধ্য । সুতরাং স্যারের ওই দিনের ক্লাস যে সকল ছাত্র-ছাত্রীরা পেয়েছিল তাদের কার্যকরন সম্পর্কের সংজ্ঞা এবং উদাহরন কোনদিন ভোলার কথা নয় ।
দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যাসন্ন । আর মাত্র ১৫ দিন পরেই অনুষ্ঠিত হবে দেশের ইতিহাসের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন । এ নির্বানকে ঘিরে দেশের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে । গত কয়েকদিনে শত লোকের প্রান বিসর্জন দিতে হয়েছে । অতীতের সকল হানাহানির রেকর্ড ভেঙ্গে সহিংসতার মাত্রা বেড়েই চলেছে । দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে সকল অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে তার একটি সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান দেয়া আবশ্যক মনে করছি । গত ২৪ অক্টোবর ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে পরবর্তী সময়ে সর্বদলীয় সরকার গঠন করার দিন থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৫৫ দিনে বাংলাদেশের মানুষের যে জান এবং মালের ক্ষতি হয়েছে তার একাংশের জরিপ তুলে ধরা হল গত ৫৫ দিনে রাজনৈতিক সংহিসতার বলি হয়েছে ১৬১ টি তাজা প্রাণ । এই ১৬১ জনের মধ্যে আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ৬৪ জন । চলমান রাজনৈতিক সংহিসতায় শুধু বি,আর,টিসি বাসের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২২ কোটি টাকা । বাংলাদেশের প্রায় ১০ লাখ সমবায়ী কৃষকের লোকসান হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা । গত কয়দিনে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার চা শিল্পে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা । প্রতি বস্তা সারের মূল্য বেড়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত । যার কারনে ভবিষ্যতে উৎপাদিত ফসলের ক্ষেত্র মারাত্মক হুমকির মূখে পড়বে । আর এসকল ক্ষতির প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতির উপর । যার কারনে দেশের দোদ্যুল্যমান অর্থনৈতিক অবস্থায় সরাসরি প্রভাব পড়েছে । এ সকল ক্ষতির প্রধান শিকার হচ্ছে দেশের খেটে খাওয়া মানুষ । চলমান হরতাল ও অবরোধের কারনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দেশের শিক্ষাক্ষাত দেশের প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে । সকল কিছুর পরেও পেট্রোল বোমার মত মারাত্মক মরানাস্ত্রের ভয়াবহ সহিংসতায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ । গত ৫৪ দিনের তিন দফা অবরোধে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে , বাংলাদেশের যোগাযেগের অন্যমত বৃহৎ মাধ্যম রেল শিল্পে । এছাড়াও তিন দফা অবরোধ ও কয়েকদফার হরতালে দেশের অন্যান্য পরিবহন মাধ্যম , শিল্প , শিক্ষা এবং ব্যবসাসহ অন্যান্য খাতে ক্ষতি হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা । যে ক্ষতি পূরণ করতে গিয়ে ভবিষ্যতে দেশের অর্থণৈতিক অবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে । দেশের এ অবস্থা জাতিকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভয়াবহ অবস্থার কথা । সরকারী দল বিরোধী দলকে এবং বিরোধীদল সরকারী দলের দিকে আঙুল উঁচিতে দায়ভার চাপাতে চাইছে । এসকল নাশকতা থেকে দেশকে রক্ষা করার মত পর্যপ্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে দেশের নিরাপত্তা বাহীনিগুলো । দেশের কিছু কিছু স্থানে নিরাপত্তা বাহীনির বিপরীতে দখল নিয়েছে হরতাল অবরোধের সমর্থক গোষ্ঠী । যার কারনে গনতন্ত্র পদ-দলিত হচ্ছে । সরকারী দল এবং বিরোধীদল যদি দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়ে সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হয় তবে দেশের যে টুকু সম্ভাবনা অবশিষ্ট আছে সে টুকুও অবশিষ্ট থাকবেনা । আসুন একনজরে দেখে নেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সর্বশেষ পরিস্থিতি । দশমজাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাংবিধানিক সর্বদলীয় সরকার সকল বাধা পেরিয়ে আস্তে আস্তে তাদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলছে । বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট নিবন্ধিত ৪০ টি রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে ১৬ টি দলকে নিয়ে গঠিত হয়েছে সর্বদলীয় সরকার । বাংলাদেশের ৩০০ টি আসনের মধ্যে ১৫৪ টি আসনের মনোনীত প্রার্থীরা ইতোমধ্যে বিনা প্রতিদন্ধিতায় বিজয়ী হয়েছেন । সুতরাং নির্বাচন কমিশনকে মাত্র ১৪৬ টি আসনে নির্বাচন দিতে হচ্ছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের পাঁচটি জেলার সকল প্রার্থী বিনা প্রতিদন্ধিতায় বিজয়ী হয়েছে । ১৫ জেলায় ১ টি করে আসনে নির্বাচন দিতে হবে কেননা অন্যান্যা আসনের প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদন্ধিতায় জয়ী আংশিক আসনে ভোট হবে এমন জেলার সংখ্যা ১০ টি । অবশিষ্ট ১২ টি জেলার সকল আসনেই ভোট হবে । সর্বশেষ সংশোধিত ভোটার তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশের ভোটার সংখ্যা মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ । এদের মধ্য থেকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪ কোটি ৩৬ লাখ লোক ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবে বাকী ভোটারদের মধ্য থেকে ৪ কোটি ৮৩ লাখ ভোটার ভোট দিতে পারেব না কেননা তাদের আসন সমূহের প্রার্থীরা তাদের ভোট ছাড়াই দেশের সংসদ সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন । দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের ৩০০ টি সংসদীয় আসনে মোট প্রার্থীর সংখ্যা ৫৮৩ জন (যা দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন) । দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহন করছেন ৩৭৪ জন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহন করেছেন ২০৯ জন । একটি আসনের জন্য সর্বোচ্চ প্রার্থী হয়েছেন ৫ জন (খাগড়াছড়িতে)।
দেশের চলমান নির্বাচন থেকে মূখ ফিরিয়ে নিয়েছে বহির্বিশ্ব । অতীত নির্বাচনে যে সকল দেশ এবং সংস্থা থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষন করার জন্য প্রতিনিধি দল পাঠানো হত , তারা বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন পর্যবেক্ষকদল পাঠাবেনা বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে । অতীতের প্রতিটি নির্বাচনে দেখা যেত প্রতিটি রাজনৈতিক দল জনগনের আশা-আকাঙ্খার দিকে লক্ষ রেখে জনগনের চাহিদা অনুযায়ী নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ণ করত । কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখনো কোন দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রনয়ন করে নি । বিশ্বের অন্যতম সংবাদ সংস্থা বিবিসি এ নির্বাচনকে আনুষ্ঠানিকতার নির্বাচন হিসেবে দেখছে । তারা জানিয়েছে , বাংলাদেশের অতীতের নির্বাচনে যেমন উচ্ছ্বাস থাকত সে রকম উচ্ছ্বাস এ নির্বাচনে নাই । তবে উত্তেজনা আছে । সেটা সংঘর্ষের উত্তেজনা ।
চলমান আন্দোলনে সরকার দলীয় নেতাদরে অভিব্যক্তি দেখে অনেকেই মত দিয়েছেন সরকার পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে । তবুও তাদের প্রেসটিজ বাঁচানোর জন্য নামকাওয়াস্তের একটি নির্বাচন দিতে হবে । মাননীয় শেখ হাসিনাকে সম্বোধন করা হবে তিনবারের সফল প্রধানমন্ত্রী যেমনটা খালেদা জিয়াকে করা হয় । ১৯৯৬ সালের মত আরেকটা নির্বাচন ২০১৪ সালে হতে যাচ্ছে । বাংলাদেশের কিছু আনাড়ি ব্যক্তি তাদের নামের পিছনে সাবেক সাংসদ লাগানোর সুযোগ পাবে । রাষ্ট্রের বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি কিংবা জানের ক্ষতির দিকে কারো কোন ভ্রক্ষেপ নেই ।
দেশের চলমান পরিস্থিতির জন্য বি এন পি পন্থীরা আওয়ামীলীগকে এবং আওয়ামী পন্থীরা বি এন পিকে দোষী সাব্যস্ত করছে । দোষটা আসলে কার সে ব্যাপারের পরিমাপক কোন নিক্তি কারো কাছে নাই । দেশে যে কয়জন নিরপেক্ষ ব্যক্তি অবশিষ্ট আছেন তারা গ্রেফতার আতঙ্কে মূখ খুলতে সাহস পাননা । স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের ৪৩ বছরে মাত্র ৪ বার সামরিক উত্থান ঘটলেও বাকী নয়বার গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে । এসকল নির্বাচনের প্রত্যেক বারই নির্দলীয় সরকার নির্বাচন কালীন সময়ে দায়িত্ব পালন করেছে । শুধু মাত্র ১৯৯৬ সালে তৎকালীন সরকারদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জনমতকে উপেক্ষা করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে প্রহসন মূলক নির্বাচন দেয় । কথিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২১ দিন রাষ্ট্র পরিচালনা করে । তৎকালীন সময়ের বিরোধীদল আওয়ামীলীগ জামাআতে ইসলামীকে নিয়ে ব্যাপক আন্দোলনে মাধ্যমে খালেদা জিয়ার সরকাররে পতন নিশ্চিত করে । সে সময়ের আন্দোলনেও অনেক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে এবং দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে । তৎকালীন সময়ে বেগম খালেদা জিয়াই তার ক্ষমতালিপসু সিদ্ধান্তের কারনে দেশের যে ক্ষতি হয়েছে তার দায়ভার নিতে বাধ্য । কেননা আওয়ামীলীগ এবং জামাআতে ইসলামী তাদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিল সেটা গনতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার আন্দোলন । সে আন্দোলনে দেশের যে ক্ষতি হয়েছে তার দায়ভার অবশ্যই খালেদা জিয়াকে নিতে হবে । যেহেতু শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে যে কার্য করেছেন সে কার্যের পিছনের কারন ছিল বেগম খালেদা জিয়ার ভূল সিদ্ধান্ত ।
মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষাগ্রহন করে । সে ইতিহাসটা যত নিকটবর্তী হয় তার প্রভাবও শিক্ষায় তত বেশি আলোকপাত করে । মাত্র ১৭ বছর আগের ইতিহাস শেখ হাসিনা এত সহজে ভূলে গেলেন কেমনে ? তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন , তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের ইতিবৃত্ত । তাতে তিনি যে বিষয়টাকে হাইলাইট করেছেন সেটা হল সামরিক বাহিনী কর্তৃক অপমান ও জেল । বাংলাদেশের মানুষ কোনদিনও চাইবেনা গনতান্ত্রিক এ দেশে সামরিক শাসন আসুক । দেশের স্বার্থ বিবেচনায় আপনাদেরও সেটা চাইবার কথা নয় । আপনাদের দুই নেত্রীর শাসনকাল যেমন হওয়ার কথা ছিল , আপনারা তেমনি ভাবে শাসনকার্য চালান না । জনগনের কাছে আপনাদের কাজের কৈফিয়ত দেয়ার একটা বিয়য় থাকলেও সেটা গনতন্ত্রের মানসকন্যাদ্বয় যেন ভূলেই যান । সেক্ষেত্রে জনগন অনুপায় হয়ে সামরিক শাসন কামনা করে । আপনারাও ভয়ে থাকেন হয়ত সামরিক শাসকদের কাছে আপনাদের জবাবদীহি করতে হবে । অবশেসে সে পথটুকুও বন্ধ করে দিলেন । জনগনের যাওয়ার শেষ আশ্রয়টুকুও শেষ পর্যন্ত অবশিষ্ট রাখলেন না । এখন দুইজন মিলে যা ইচ্ছা তাই করবেন । আপনাদের আর পায় কে ? মানুষ হত্যা করবেন , দেশের সম্পদ ধ্বংস করবেন । কৈফিয়ত না দিতে হলে যা ইচ্ছা তাই করা যায় । ভৌগলিক কারনেই আমাদের নীতি নৈতিকতা একটু কম । সকল কিছুর পরেও কার্যকরন সম্পর্ককে অস্বীকার করতে পারবেন কি ? কার্যকরনের সূত্রধরেই সকল কিছুর দায়ভার যার উপর বর্তাবে তাকেই এর জন্য দায়ী করা হবে । পরবর্তীতে বেঁচে থাকলে জবাবদীহিও করতে হবে
লেখক : রাজু আহমেদ
শিক্ষার্থী , কলামিষ্ট ও প্রাবন্ধিক
সরকারী বি এম কলেজ , বরিশাল

No comments:

Post a Comment